NewsRecent News

তালিবান নীতির  পরিবর্তনে নয়াদিল্লি?

দিলীপ চট্টোপাধ্যায়,মানুষের মতামত:দক্ষিণ এশিয়ায় চলমান সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে মোদী সরকার তার তালিবান নীতি পরিবর্তনের রাস্তায় এগিয়েছে।অনেক দিনই এমন সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। মূলতঃ বিদেশমন্ত্রী এস জয়শংকর ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল আফগানিস্থানের শাসক গোষ্ঠী তালিবান সম্পর্কে নীতি বদলের কথা বলেছেন।মোদী সরকার এই প্রত্যাশাকে সিলমোহর দিয়েছে।আফগান নীতির পরিবর্তনের পর ধীরে ধীরে আবার নয়াদিল্লি-কাবুলের মধ্যে পুর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

মূলতঃ সংযুক্ত আমির শাহির মধ্যস্থতায় দুবাইয়ে বেশ কবার ভারত সরকার ও তালিবান শাসক প্রতিনিধিদের বৈঠক হয়েছে। তালিবানের তাগিদ ছিল বেশি।অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়াত ভূ-রাজনৈতিক ঘটনাবলিতে নয়াদিল্লিও কৌশলগত ভাবে তালিবান নীতির পরিবর্তন ঘটিয়েছে। পাকিস্থানের অভ্যন্তরে বালুচ বিদ্রোহ,পাক- আফগান সীমান্তে বড় রকমের সংঘাতের পর কাবুল-ইসলামাবাদের সম্পর্ক এখন তলানিতে।অতীতে কাশ্মীরে সীমান্ত পার সন্ত্রাসে তালিবান,বিশেষ করে হাক্কানি গোষ্ঠীর মদত ছিল।এখন তালিবান ভারত বিরোধিতা, সীমান্তপার সন্ত্রাসে মদতের রাস্তা থেকে সরতে চায়।

তালিবান স্পষ্ট আশ্বাস দিয়েছে যে,দিল্লি-কাবুল স্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পাশে আগগানিস্থানে নানা পরিকাঠামো ক্ষেত্রে থমকে থাকা দিল্লির লগ্নি নির্ভয়ে নিবেশ করুক দিল্লি।কাশ্মীরে সীমান্তপার সন্ত্রাসে কাবুল কোন মতেই যুক্ত হবে না। আফগানিস্থানের মাটিতে কোন রকম ভারত বিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীর আশ্রয়স্থল হবে না বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কাবুলের বর্তমান শাসক গোষ্ঠী তালিবানরা। পাকিস্থানপন্থী ভারত বিরোধী হাক্কানি গোষ্ঠী সম্পর্কেও সরব তালিবানের নেতারা।

আফগানিস্থানের সঙ্গে দুবাইয়ে একাধিক বৈঠকের পরই মোদী সরকারের বিদেশ দপ্তর তাদের চলতি তালিবান নীতির পরিবর্তন ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেন।এক্ষেত্রে জয়শংকর-ডোভালরা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন তা বলাই বাহুল্য।

যদিও ভারতের কূটনৈতিক মহলের একাংশ তালিবান নীতির পরিবর্তনে দিল্লির সাউথ ব্লক কর্তাদের বিস্তর ঝুঁকি রয়েছে বলেই মনে করছেন।ভারতের বিদেশ দপ্তরের শীর্ষ আধিকারিকদের পাশে দেশের বিদেশ মন্ত্রী, বিদেশ সচিবের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের বেশ কবার তালিবান প্রশ্নে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও এ নিয়ে বিদেশ মন্ত্রী, বিদেশ সচিব ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে বেশ কবার সরাসরি কথা বলেছেন।

নয়াদিল্লি-কাবুল সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে সংযুক্ত আমির শাহির কূটনৈতিক কর্তারাও দিল্লি, কাবুলের সঙ্গে কথা বলে দুবাইয়ে বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। এরপর দুদেশের সম্পর্কে বরফ গলতে শুরু করেছে। সংযুক্ত আমির শাহির উদ্যোগেই নয়াদিল্লি-কাবুল সম্পর্কে নতুন মোড় নিতে চলেছে।নিজেদের বিদেশনীতি বদলে আফগানিস্তানে তালিবানের সঙ্গে গোপনে আলোচনার দরজা খুলেছে ভারত। কূটনীতিকদের মতে,এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সাহসী। তবে এতে নির্দিষ্ট কিছু লাভের সম্ভাবনা যেমন আছে, তেমনই ঝুঁকিও কম নয়।

নয়াদিল্লি বরাবরই কাবুলকে দেখে ইসলামাবাদের কথা মাথায় রেখে। সাউথ ব্লকের দিক থেকে চেষ্টা করা হয়, যাতে আফগানিস্তানের জাতীয়তাবাদী অংশ মজবুত হয়। যারা পাকিস্তানের নাক গলানো বরদাস্ত করবে না। যে কারণে ‘আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রিত’, ‘আফগানিস্তানের নেতৃত্বে’ শান্তি প্রক্রিয়ার কথাই বলে থাকে নয়াদিল্লি। প্রশ্ন হল,এই পরিপ্রেক্ষিতে সরাসরি তালিবানের সঙ্গে আলোচনা কতটা যুক্তিযুক্ত?

বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, তালিবানের একটা বড় অংশই কাবুলে ভারতের উপস্থিতি এবং কাজকে স্বীকৃতি দেয়। তারা প্রাথমিক ভাবে চাইবে না ভারতকে হটাতে। পাশাপাশি এটাও ধর্তব্যের মধ্যে রাখা হচ্ছে যে, আফগানিস্তান থেকে ভারত-বিরোধী জঙ্গিদের উচ্ছেদ করতে তালিবান হয়তো বিশেষ সক্রিয়তা দেখাবে না। কিন্তু তালিবানের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে গেলে তারা অন্তত এই জঙ্গিদের সহায়তা করা থেকে বিরত থাকতে পারে।

তবে এর বুঝুঁকিও রয়েছে। পাকিস্তানের ইন্ধনে যে কোনও মুহূর্তে পিছিয়ে যেতে পারেন তালিব নেতারা। নিশানা করতে পারেন ভারতীয় স্বার্থকে। তালিবানে তরফে যাঁরা আলোচনা চালাচ্ছেন, তাঁদের সরিয়ে দিয়ে পাকিস্তানের মদত পাওয়া হক্কানি গোষ্ঠীর

মতো কট্টরপন্থীদের আমদানি করা হতে পারে।এ কথাও খেয়ালে রাখা হচ্ছে যে, বেশির ভাগ তালিবান নেতার পরিবার থাকে পাকিস্তানে। ইসলামাবাদ বরাবরই তালিবানের সঙ্গে দর কষাকষির প্রশ্নে এই বিষয়টিকে কাজে লাগায়। তালিবানের সঙ্গে যে এখনও লস্কর-ই-তইবা, আল কায়দার মতো জঙ্গি গোষ্ঠীর যোগাযোগ রয়েছে, সেটাও প্রমাণিত। ভারতীয় সূত্রের বক্তব্য, তালিবানের সঙ্গে নয়াদিল্লি কথা বলুক বা না-বলুক, এমনিতেও তাদের সঙ্গে পাক মদত পাওয়া জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির যোগাযোগ রয়েছে। ভারত বরাবরই এ নিয়ে উদ্বেগে থাকে। কিন্তু তালিবান-অক্ষ থেকে নিজেদের পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেললে, পরে তারা ক্ষমতায় এলে ভারতের উদ্বেগ আরও বাড়বে।

ভারতের কৌশলগত বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৯৯৯ সালের কন্দহর কাণ্ড যে বিরাট লজ্জার মধ্যে ভারতকে ফেলেছিল, তার থেকে এখনও মুক্তি পাওয়া যায়নি। কিন্তু সেই ঘটনার জালে তালিবান-নীতিকে বন্দি করে রাখাটাও কাজের কথা নয়। এটাও বিদেশ মন্ত্রক মনে করে যে, ক্ষমতায় এলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশাসনিক কারণে ভারতের উপর নির্ভরতা বাড়বে তালিবানের। কারণ পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রের উপর অতিনির্ভরতা, প্রশাসনিক এবং আর্থিক ক্ষেত্রে আফগানিস্তানকে যে কোথাও পৌঁছে দেবে না সেটা তারাও জানে। ভারতের তালিবান নীতি রূপায়নের ক্ষেত্রে যে, নয়াদিল্লি অতি সতর্ক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ছবি ও পাকিস্থান-আফগানিস্থান সংঘাতের মধ্যে নতুন করে নয়াদিল্লি-কাবুল সম্পর্ক নতুন কোন সমীকরণের ইংগিত দেয় সে দিকেই তাকিয়ে ভারতের কূটনৈতিক মহল। তালিবানের উদারপন্থী ভারত সম্পর্কে নরম অংশ নয়াদিল্লি-কাবুল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করার ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিতে চলেছেন। হাক্কানি গোষ্ঠীকে তালিবানের মূল আফগান জাতীয়তাবাদের স্রোত থেকে পৃথক করা হয়েছে।

তালিবান শাসনকালেই ছিন্ন হওয়া ভারত-আফগানিস্থান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন সমীকরণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহমত কাবুল, অবশ্যই নয়াদিল্লি। অতি সতর্কতার মধ্যেই এই সম্পর্কের নয়া মোড় অসুবিধাজনক অবস্থায় পড়তে চলেছে একদিকে পাকিস্থান, অন্যদিকে চীন। তালিবান যুগের পুর্বে আফগানিস্থানে জাহির শাহের রাজতন্ত্রের সময় থেকেই ভারত-আফগান সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্যে নতুন করে কাবুল-নয়াদিল্লি সম্ভাব্য সমীকরণে যে ইসলামাবাদের শাসকদের সঙ্গে তাদের অকৃত্রিম বন্ধু চীনও বেজায় চিন্তায় তা আর বলার অপেকশা রাখে না।

Share with

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *