NewsRecent News

বিচারকের অভাব ও বিচারপ্রক্রিয়ার বিলম্ব: ন্যায়বিচার কি অধরাই থাকবে?

নিজস্ব প্রতিবেদক,মানুষের মতামত:ভারতের বিচারব্যবস্থা গণতন্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে, দেশের অধিকাংশ জেলা আদালতে পর্যাপ্ত বিচারক নেই, হাজার হাজার মামলা বছরের পর বছর ধরে ঝুলে রয়েছে। শুধু নিম্ন আদালতই নয়, কলকাতা হাইকোর্টসহ অন্যান্য উচ্চ আদালতেও বিচারপতির স্বল্পতা প্রকট। ফলে সাধারণ মানুষ আইন ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রেখেও বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা ও পরিসংখ্যান

ন্যাশনাল জুডিশিয়াল ডাটা গ্রিডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে দেশের নিম্ন আদালতগুলোতে প্রায় ৪ কোটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। শুধু হাইকোর্টগুলোতেই বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৬০ লাখের বেশি। সুপ্রিম কোর্টেও বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়েছে।

ভারতে গড়ে প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য মাত্র ২১ জন বিচারক রয়েছেন, যেখানে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী এই সংখ্যা হওয়া উচিত ৫০-৫৫ জন। কলকাতা হাইকোর্টের কথা বললে, ৭২টি অনুমোদিত বিচারপতির পদ থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে একাধিক পদ খালি রয়েছে। এই অভাব মেটানোর জন্য সুপ্রিম কোর্ট ও কেন্দ্র সরকার একাধিকবার ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও বাস্তবে পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি বলেই অভিযোগ ।

বিচারকের স্বল্পতার কারণ

১. নিয়োগ প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা:

বিচারপতি ও বিচারকদের নিয়োগে একাধিক ধাপ থাকে, যা সময়সাপেক্ষ। হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের জন্য কলেজিয়াম ব্যবস্থা থাকায় বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া ধীরগতিতে চলে।

২. পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব:

অনেক নিম্ন আদালতে পর্যাপ্ত ঘর, প্রযুক্তি, কর্মী ও সহায়তাকারী স্টাফের অভাব রয়েছে, যা বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে।

3. সরকারের গড়িমসি:

অনেক সময় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার বিচারক নিয়োগের সুপারিশ গ্রহণ করতে দেরি করে, ফলে শূন্যপদ পূরণ হয় না।

4. আইনজীবীদের বিচারপতি হতে অনীহা:

অনেক দক্ষ ও অভিজ্ঞ আইনজীবী বিচারপতি হতে আগ্রহী নন, কারণ তাঁদের ব্যক্তিগত আইনি চর্চায় বেশি উপার্জনের সুযোগ থাকে। ফলে উচ্চ আদালতে যোগ্য বিচারপতি খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়।

প্রভাব ও সাধারণ মানুষের ভোগান্তি

বিচারক স্বল্পতার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় ক্ষেত্রেই মামলা নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর লেগে যায়। কোনো মামলার রায় আসতে ১০-১৫ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। ফলে একদিকে অভিযুক্ত ব্যক্তি দীর্ঘদিন কারাবন্দি থাকেন, অন্যদিকে নিরপরাধ ব্যক্তিরাও দ্রুত মুক্তি পান না।

বাণিজ্যিক মামলা ও সরকারি সংস্থার মামলাগুলোও বছরের পর বছর আটকে থাকায় অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আদালতে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে বিনিয়োগকারীরাও ব্যবসা করতে নিরুৎসাহিত হন।

সমাধানের উপায়

১. দ্রুত বিচারক নিয়োগ:

সরকার ও সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে সমন্বয় বাড়িয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুততর করতে হবে।

২. প্রযুক্তির ব্যবহার:

ভার্চুয়াল কোর্ট, ডিজিটাল কেস ম্যানেজমেন্ট, এবং এআই-ভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করলে মামলা নিষ্পত্তির গতি বাড়বে।

৩. বিচারক সংখ্যা বাড়ানো:

আইন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বিচারকের সংখ্যা দ্বিগুণ করতে হবে, যাতে মামলার তুলনায় বিচারকের ভারসাম্য ঠিক থাকে।

৪. ফাস্ট-ট্র্যাক কোর্ট বৃদ্ধি:

সংবেদনশীল ও দীর্ঘদিনের বিচারাধীন মামলাগুলোর জন্য বিশেষ ফাস্ট-ট্র্যাক কোর্ট গঠন করতে হবে।

বিচারপ্রক্রিয়ার বিলম্ব শুধু সাধারণ মানুষের নয়, গোটা বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থার সংকট তৈরি করছে। বিচারক নিয়োগের অভাবের কারণে এই সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে “ন্যায়বিচার” শব্দটি শুধু আইনের বইতেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে, বাস্তবে নয়। তাই অবিলম্বে বিচারক নিয়োগ ও প্রযুক্তির সাহায্যে মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। নাহলে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ কমার কোনও সম্ভাবনা নেই।

Share with

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *