NewsRecent News

পশ্চিমবঙ্গে বনাঞ্চলের সংকট: ক্রমহ্রাসমান সবুজ প্রকৃতি ও উদ্বেগ

নিজস্ব প্রতিবেদক,মানুষের মতামত:বনাঞ্চল ধ্বংস ও নগরায়ণের বিস্তারের ফলে পশ্চিমবঙ্গে সবুজের পরিমাণ ক্রমাগত কমছে। বেআইনি কাঠ কাটার পাশাপাশি বাণিজ্যিক ও আবাসন প্রকল্পের কারণে বনভূমির পরিসর ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে। ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের মোট বনভূমি যা ছিল ২০২৩-২৪ সালে তা থেকে অনেকই কমে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ,মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে অনেকাংশেই বনাঞ্চল হ্রাস পেয়েছে। এই পরিস্থিতি পরিবেশবিদদের কাছে এক গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

বনাঞ্চল হ্রাসের প্রধান কারণ

 

১. বেআইনি কাঠ কাটা ও চোরাকারবার

 

উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ জঙ্গলে চোরাই কাঠের কারবারীরা বেআইনিভাবে গাছ কেটে ফেলে। বিশেষ করে সুন্দরবন, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং, ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর, ও মুর্শিদাবাদের মতো এলাকাগুলিতে গাছ কাটার প্রবণতা বেশি। বেশ কিছু জায়গায় বনদপ্তরের নজরদারির অভাব এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা এই সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলছে।

 

২. নগরায়ণ ও শিল্পায়ন

 

পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শহরে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে, যার ফলে বনাঞ্চল ধ্বংস হচ্ছে। কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী জেলা উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ বনভূমি কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হচ্ছে। নতুন নতুন আবাসন প্রকল্প, রাস্তাঘাট ও শিল্পাঞ্চল তৈরি করার জন্য বনভূমির জমি ব্যবহার করা হচ্ছে।

 

৩. কৃষিজমির সম্প্রসারণ

 

বর্ধমান, হুগলি, দক্ষিণ দিনাজপুর এবং কোচবিহার অঞ্চলে কৃষি সম্প্রসারণের জন্য বনাঞ্চল কেটে ফেলা হচ্ছে। জমির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য অনেক সময় গাছ কেটে চাষের জমি তৈরি করা হয়। যদিও এই প্রক্রিয়া ক্ষণস্থায়ীভাবে কৃষকদের উপকৃত করে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়।

 

৪. জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ

 

বনাঞ্চল হ্রাসের ফলে জলবায়ুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, গ্রীষ্মকালে অস্বাভাবিক উচ্চ তাপমাত্রা ও খরার মতো সমস্যা বাড়ছে। সুন্দরবন ও উপকূলবর্তী বনাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের ফলে প্রচুর গাছপালা নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বনাঞ্চলের প্রকৃতি পরিবর্তিত হচ্ছে, যা গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করছে।

 

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের উপর প্রভাব

 

বনাঞ্চল কমার ফলে রাজ্যের বিভিন্ন পশুপাখির অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে। বিশেষ করে হাতি, বাঘ, হরিণ, গৌড়, লেপার্ড, বানর ও নানা প্রজাতির পাখির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাচ্ছে। উত্তরবঙ্গের জঙ্গলগুলিতে বন্যপ্রাণীদের বাসস্থান ধ্বংস হওয়ার ফলে হাতি ও অন্যান্য প্রাণীরা লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে, যার ফলে মানব-প্রাণী সংঘাতের ঘটনা বাড়ছে।

 

সুন্দরবনের বনাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়েছে। ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংস হওয়ায় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সুন্দরবনের মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলছে।

 

সমাধানের পথ

 

বনাঞ্চল রক্ষা ও পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

 

১. কঠোর আইন প্রয়োগ

 

বনসম্পদ রক্ষা করতে কঠোর বন আইন প্রয়োগ করা দরকার। বেআইনি কাঠ কাটার বিরুদ্ধে কড়া শাস্তির ব্যবস্থা করা এবং বনদপ্তরের নজরদারি বাড়ানো দরকার। ড্রোন ও স্যাটেলাইট প্রযুক্তির মাধ্যমে বনাঞ্চলের উপর নিয়মিত নজরদারি চালানো যেতে পারে।

 

২. পুনঃবনায়ন কর্মসূচি

 

বনাঞ্চল পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যাপকভাবে গাছ লাগানো দরকার। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বৃক্ষরোপণ অভিযান চালিয়ে হারানো সবুজ ফেরানো সম্ভব।

 

৩. জনসচেতনতা বৃদ্ধি

 

পরিবেশ রক্ষার জন্য সাধারণ মানুষকে সচেতন করা জরুরি। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিবেশগত সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বন সংরক্ষণের গুরুত্ব বোঝাতে হবে, যাতে তারা নিজেদের স্বার্থেই বন ধ্বংসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।

 

৪. বিকল্প জীবিকার সুযোগ তৈরি

 

বনভূমির উপর নির্ভরশীল মানুষের জন্য বিকল্প জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে তারা গাছ কাটার কাজ থেকে দূরে থাকতে পারেন। পরিবেশবান্ধব পর্যটন ও সামাজিক বনসৃজন প্রকল্প চালু করা যেতে পারে, যা স্থানীয় মানুষকে উপার্জনের সুযোগ দেবে এবং বন সংরক্ষণের কাজেও সাহায্য করবে।

 

৫. নগরায়ণের সুষ্ঠু পরিকল্পনা

 

শহর ও গ্রামীণ অঞ্চলে নগরায়ণের সঠিক পরিকল্পনা তৈরি করা দরকার, যাতে বনভূমি অকারণে ধ্বংস না হয়। নতুন আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার সময় পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করা উচিত।

 

পশ্চিমবঙ্গের বনাঞ্চল হ্রাস যে হারে চলছে, তাতে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ পরিবেশগত সমস্যা দেখা দিতে পারে। বনভূমি রক্ষা করা শুধুমাত্র সরকারের দায়িত্ব নয়, বরং সাধারণ মানুষ, পরিবেশবিদ ও প্রশাসনের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সঠিক পরিকল্পনা, জনসচেতনতা এবং কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। সবুজ প্রকৃতি রক্ষার জন্য এখনই ব্যবস্থা না নিলে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এর মারাত্মক পরিণতি ভোগ করতে বাধ্য হবে।

Share with

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *